পীরগঞ্জের ঐতিহাসিক পটভূমি
প্রাচীন কালে পীরগঞ্জঃ রংপুরের অংশ হিসেবে প্রাচীন কালে পীরগঞ্জ কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। পৌরাণিক যুগে মহিরঙ্গ দানব ছিল কামরূপের প্রথম রাজা। মহিরঙ্গ রাজার পর চার জন রাজা গত হলে রামায়নের যুগে নরক রাজা কামরূপে রাজত্ব করেন। সে সময় পীরগঞ্জের করতোয়া নদী পর্যন্ত কামরূপ রাজ্য বিস্তৃত ছিল।
মহাভারতের যুগে কামরূপের রাজা হন ভগদত্ত। এই কামরূপ রাজা ভগদত্তের রংমহল ছিল ঘাঘট নদীর তীরে। তাই এ স্থানের নাম রংপুর হয়েছে বলে কোন কোন ঐতিহাসিকগণ মন্তব্য করেছেন। রংপুরের অদুরে মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রা বন্দের নাম করণ হয়েছে রাজা ভগদত্তের কন্যা পায়রা মতির নামানুসারে।
রাজা ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পঞ্চ পান্ডবের অন্যতম বীর অর্জুনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন। ১৯০৫-১০৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গোপী চাঁদ রাজা কামরূপে রাজত্ব করেন। গোপী চাঁদ বা রাজা গোবিন্দ চন্দ্রের রাজধানী ছিল নীলফামারী জেলার অন্তর্গত ডিমলা উপজেলার পাটিকা নগরে। এই পাটিকা নগরীর স্মৃতি বহন করছে পীরগঞ্জের পাটিকাপাড়া গ্রামে। পীরগঞ্জের বাগদুয়ার, দানেশনগর, লোরারপাট, উদয়পুর ঊল্লেখিত রাজ-রাজড়াদের ও তাদের বংশধরদের স্মৃতি বহন করে আসছে। উল্লেখ্য যে, প্রাচীন কালে পীরগঞ্জে বাগদুয়ার পরগণার অধীন ছিল পাটকাপাড়া এবং উদয়পুর। বর্তমানে তা মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্ভূক্ত।
মধ্যযুগে পীরগঞ্জঃপঞ্চদশ শতাব্দীতে কামরূপে অভ্যূদয় ঘটে সেন রাজ বংশের। নীল ধ্বজ, চক্র ধবজ ও নীলাম্বর ছিলেন এই রাজ বংশের প্রভাবশালী রাজা। নীল ধ্বজ, কুচবিহার, নিম্ন আসাম ও বৃহত্তর রংপুর প্রভৃতি নিয়ে কামতা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। নীল ধ্বজ এর পর যথাক্রমে চক্র ধ্বজ ও নীলাম্বর কামতা রাজ্যের অধিশ্বর হন। রাজা নীলাম্বর তার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন। পীরগঞ্জের চতরাহাটের পশ্চিম পার্শ্বে নীল দরিয়ার দূর্গ তাদের অন্যতম। কামতা রাজ্য করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট পর্যন্ত ছিল তার রাজ্যর দক্ষিণ সীমা। রাজধানী কামতাপুর থেকে ঘোড়াঘাট পর্যন্ত যে মেঠো রাজপথটি দৃষ্ট হয়, তা রাজা নীলাম্বর কর্তৃক নির্মিত।
সুপ্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র চতরা হাটের পশ্চিম পার্শ্বে এই রাজ পথটি অতিক্রম করে অর্দ্ধ কিঃমিঃ পথ রিক্সা, ভ্যান বা পাঁয়ে হেটে সামনে অগ্রসর হলেই রাজা নীলাম্বরের দূর্গ বা নীল দরিয়ার দূর্গের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টি গোচর হয়। এখানে ৯২.০০ একর সুবিশাল জলাধার বেষ্টন করে আছে ৪৮ একর স্থল ভাগকে।
এ ঐতিহাসিক স্থানটির সাথে বিজড়িত পীরগঞ্জের ইতিহাস। জড়িত রয়েছে এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সুমহান স্মৃতি। তিনি হলেন মধ্য যুগের ইসলাম প্রচারক পির দরবেশ ও যোদ্ধা পুরুষ হযরত শাহ ইসমাঈল গাজি (রহঃ)। দরিয়ায় তার দরগা এবং দরিয়ার অদুরে কাঁটাদুয়ার নামক স্থানে আজও তার পবিত্র মাজার বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নে তার সম্পর্কে সম্যক আলোচনা করা হলো।
হযরত শাহ্ ইসমাঈল গাজি (রহঃ)
মধ্যযুগে সমগ্র আরব জাহানে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীয়ন হয়। ভারত উপ-মহাদেশেও প্রবাহিত হয় তার সুমেয় বায়ু। এ সময় সুলতানী আমলে বাংলাদেশে যে সমস্ত সুফি-সাধক সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন, তাদের মধ্যে হুগলি জেলার জাফর খাঁন গাজি, খুলনা বাগেরহাটের খাঁন জাহান আলী এবং হযরত শাহ্ ইসমাঈল গাজির নাম উল্লেখযোগ্য।
হযরত শাহ ইসমাঈল গাজি (রহঃ) মক্কার কোরেশ বংশীয় একজন যোদ্ধা পুরুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন পির ও দরবেশ। ইসলাম ধর্ম প্রচারের সুমহান ব্রত নিয়ে তিনি সুদুর আরব-পারস্য থেকে বহু ক্লেশকর পথ অতিক্রম করে বাংলায় এসে উপস্থিত হন। স্বপরিবারে বসবাস করেন লখ্নৌতে। এ সময় বাংলার সুলতান ছিলেন রুকনুদ্দীন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দে)। শাহ ইসমাঈল গাজি প্রথমতঃ তার রাজ দরবারে সাধারণ সৈনিক হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করেন। অত্যল্প সময়ের মধ্যে গাজি সাহেবের শৌর্য -বীর্যে আকৃষ্ট হয়ে সুলতান তাকে সেনাপতি দায়িত্ব দিয়ে রাজা-গজপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান প্রেরণ করেন। গাজি সাহেব রাজা গজপতিকে যুদ্ধে পরাজিত করে মান্দারায়ন দূর্গ দখল করেন। পরবর্তীতে দিনাজপুরের মহিসন্তোষ ক্ষেত্রে গাজি সাহেব রাজা কামেশ্বরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাঁর সর্বশেষ অভিযান ছিল কামরূপ-কামতা রাজা নীলাম্বরের বিরুদ্ধে। অলৌকিকভাবে তাকে পরাজিত করে তিনি পীরগঞ্জের এই নীল দরিয়ার দূর্গ হস্তগত করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঈর্ষান্বিত হয়ে ঘোড়াঘাটের জায়গীরদার রাজা ভান্ডুসি রায় গাজি সাহেবকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। পরিশেষে তার বিরূদ্ধে সুলতানের অবাধ্যতার মিথ্যা অভিযোগ এনে রুকনুদ্দীন বারবক শাহকে বিভিন্ন ভাবে প্ররোচিত করেন রাজা ভান্ডুসি রায়। ফলে ১৪৭৪ খিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি মোতাবেক ৮৭৮ হিজরির ১৪ শাবান রোজঃ শুক্রবার আছরের নামাজান্তে সুলতানের আদেশে কাঁটাদুয়ার নামক স্থানে গাজি সাহেবের শিরশ্চদ করা হয়। সুলতানের আদেশে তার মস্তক কাটা দুয়ারে এবং মস্তক বিহীন দেহ ভারতের মান্দারায়নে সমাধিস্থ করা হয়। কাঁটাদুয়ারে আজও তার পবিত্র মাজার বিদ্যমান আছে।
পীরগঞ্জের বড় বিলায় ছিল তার প্রশাসনিক দপ্তর। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গাজি সাহেবের পূর্বাপরে একশত বৎসরের মধ্যে উল্লেখিত নামে আরো দুই জন ইসলাম ধর্ম প্রচারক পীরগঞ্জের মাটিতে তশরিফ আনয়ন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন নুর বদর জঙ্গ গাজির সেনাপতি মুহাম্মদ ইসমাঈল গাজি।
আর একজন আলাউ্দ্দীন হোসেন শাহের সেনাপতি শাহ ইসমাঈল গাজি আফগানী। কাঁটাদুয়ার, বড় দরগা, সহ পীরগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ইসমাঈল গাজির যে সমস্ত মাজার দৃষ্ট হয় তা একই ব্যক্তির নহে। এ ব্যাপারে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
পির আব্দুস সাত্তারি রচিত রিশালাতুশ শুঁহাদা নামক গ্রন্থে হযরত শাহ ইসমাঈল গাজির জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে বলে জানা যায়। তবে সে গ্রন্থ খানা বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। রংপুরের কালেক্টর মিঃ ড্যামন্ট উক্ত গ্রন্থের কিছু অংশ ইংরেজিতে অনুবাদ করে এশিয়াটিক সোসাইটির এক জার্নালে প্রকাশ করেছিলেন। যা হোক পীরগঞ্জের ইতিহাসে হযরত শাহ্ ইসমাঈল গাজীর স্মৃতি ওতঃপ্রতভাবে বিজড়িত।
সাধক কবি কাজি হেয়াত মামুদ
পীরগঞ্জের সাধক কবি কাজি হেয়াত মামুদ। একজন ক্ষণজন্মা মহা পুরুষ। বাংলাদেশের এক নিভৃত পল্লীতে জন্ম গ্রহণ করে স্বমহিমায় ভাস্কর তিনি। তাঁর সম্পর্কে অনেক কাহিনী দীর্ঘদিন যাবত দাবাগ্নির মতই অজ্ঞাত ছিল। আজ সময়ের প্রয়োজনে ফেটে বেরুচ্ছে তার লেলিহান শিখা। তাই পীরগঞ্জের ইতিহাসে তাঁর জীবন ও সাহিত্য কর্ম বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জানা, বিচার-বিশ্লেষন জরুরি।
কাজি হেঁয়াত মামুদ ১৬৮০ থেকে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান বর্তমান রংপুর জেলার অন্তর্গত, পীরগঞ্জ উপজেলাধীন ১নং চৈত্রকোল ইউনিয়নিস্থ ঝাড় বিশিলা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম শাহ কবির। মাতার নাম খায়রুন্নেছা। তাঁরা ছিলেন মোঘল সুবেদার মীর জুমলার বৃত্তি ভোগী এলিট মুসলিম পরিবার।
হেঁয়াত মামুদ স্বগৃহে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ঘোড়াঘাটে বিদ্যার্জন করেন। সে সময় বাংলা ভাষার পাশাপাশি তিনি সংস্কৃতি, আরবি ও ফারসি ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। সেই সঙ্গে ইসলামি ভাব ধারায় রচিত পাশ্চাত্যের কাব্য সাহিত্যগুলো বাল্যকাল থেকেই তাঁকে বাংলা কাব্য সাহিত্য রচনার প্রেরণা যোগায়। তদুপরি ইসলাম ধর্মীয় আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলার প্রয়াস উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত হন তিনি।
হেঁয়াত মামুদ শিক্ষা জীবন শেষ করে ঘোড়াঘাটের ফৌজদারের অধীনে তৎকালীন সুলুঙ্গা বাগদার পরগণার কাজি নিযুক্ত হন। কাজি অর্থ বিচারক। বিচার কার্যে তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতি, ন্যায়-নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষতা সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের সুমহান ব্রত নিয়ে হযরত শাহ ইসমাঈল গাজি পবিত্র তশরিফ আনয়ন করেন। তাঁর বিশাল বিজয়, অলৌকিক কাহিনী ও নৃশংস হত্যাকান্ড সেকালের শাসকগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ ও তাঁর সাথে নানাভাবে সম্পর্কিত এলিট মুসলিম পরিবার গুলো লা-খেরাজ সম্পত্তি এবং বৃত্তি সহ বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করতে থাকেন।
সে কারণে এ সমস্ত মুসলিম পরিবার কোন রাজনৈতিক ঝুট-ঝামেলায় না গিয়ে বাংলা ভাষার সাথে সংস্কৃতি, আরবি, ও ফারসি শব্দ সংমিশ্রনে পুঁথি সাহিত্য রচনা এবং আধ্যাত্ব সাধনায় নিমগ্ন হন। হেয়াত মামুদের পিতা শাহ কবির তাদের অন্যতম। পরবর্তীতে বংশানুক্রমে শাহ্ ইসমাঈল গাজির প্রচারিত ইসলাম ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং আধ্যাত্বিক ভাবধারা কাজি হেঁয়াত মামুদের পুঁথি সাহিত্যে লক্ষণীয়। শুধু তাই নয়, হযরত শাহ ইসমাঈল গাজির বিদেহী আত্মার প্রতি তার মনের শ্রদ্ধানিবেদন আম্বিয়া বাণীতে পাওয়া যায় এভাবেঃ-
‘ঘোড়াঘাটে বঁন্দো শা ইসমাঈল গাজী,
বাহু বলে তুড়িল রিপুর দাগা বাজি।
এক মনে বন্দোঁ সব আওলিয়া যামন্ত
সান বিদ্ধ সা দরিয়া বোখারী মহন্ত’।
কাজি হেয়াত মামুদের প্রথম পুঁথি ‘জঙ্গনামা’। কারবালায় মুয়াবিয়া পুত্র এজিদ কর্তৃক হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) এর শহিদ এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ নিয়ে ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে কবি উক্ত পুঁথি রচনা করেন। জঙ্গনামা পুঁথিতে কারবালা যুদ্ধের ভয়াবহতা কবি এভাবেই বর্ণনা করেছেন।
‘‘জঙ্গ লাগিল, লাগিল জঙ্গ লাগিল রে,
রণ জয় রণ ঘটা বাজিল বাজিল রে’’।
উক্ত পুঁথিতে কবির জন্মস্থান ঝাড় বিশিলা গ্রামের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন-
‘‘শুন ভাই নিবেদন, কহি আমি বিবরণ,
যেন মতে রচিনু পয়ার।
এ ঝাড় বিশিলা গ্রাম, চতুর্দিকে যার নাম
প্রগণে সুলুঙ্গা বাগদ্বার’’।
১৭৩২ খ্রিস্টাব্দে কাজি হেয়াত মামুদ রচনা করেন চিত্ত উত্থান বা সর্বভেদ বাণী। সর্বভেদ বাণীতে কবি বিদ্যা শিক্ষা সম্পর্কে বলেনঃ-
‘‘যার বিদ্যা নাই সে জানেনা ভাল মন্দ
শীরে দুই চক্ষু আছে তথাপি সে অন্ধ’’।
কাজি হেঁয়াত মামুদের তৃতীয় কাব্য গ্রন্থ হিতজ্ঞান বাণী। ইহা রচিত হয় ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে। ইসলাম ধর্মীয় আচার-আচরণ এ কাব্যের মুল উপজীব্য। হিতজ্ঞান বাণীতে কবি শেষ নবী (সঃ) সম্পর্কে লিখেছেনঃ-
‘‘নবী নাও, নবী ভাও, নবী যে কান্ডার,
নবী বিনে গতি নাই ভব তরী পার’’।
কবির সর্বশেষ কাব্য গ্রন্থ আম্বিয়া বাণী। ইহা রচিত হয় ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। নবী রাসুলগণের মাহাত্ম বর্ণিত হয়েছে এ কাব্যে। আল্লাহ ও রাসুলের সান্নিধ্য লাভ করতে গেলে পির বা গুরুর মাধ্যম জরুরি। এ নিগুঢ় তত্ত্ব সূফি বাদের ইঙ্গিত দেয়। কবি হেঁয়াত মামুদ কাদেরিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। তাঁর পির বা গুরু ছিলেন শাহ কাশেম। তাঁর পির শাহ দরিয়া বোখারী। ঘোড়াঘাটে আজও তাঁর মাজার শরিফ বিদ্যমান আছে। দরিয়া বোখারীর মাজার সন্নিকটে মাওঃ নুর উদ্দিন এবং হযরত শাহ ইসমাঈল গাজির স্মৃতি স্তম্ভ লক্ষিত হয়। যা হোক আপন পির বা গুরুর প্রতি কবির মনের গভীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের বিবরণ পাওয়া যায় আম্বীয়া বাণীতেঃ
‘‘গুরু গতি গুরু মতি, গুরু আদ্যমুল,
গুরুতে চিনিয়া পাই যে, আল্লা-রাসুল।
বাপ-মাএ জন্ম দিল, গুরু দিল জ্ঞান,
অন্ধকের তরে যেন দিল চক্ষুদান’’।
.....................................
গুরু সেব, গুরু ভজো, গুরু কর সার,
গুরু বিনে নাহি গতি ভব তরিবার।’’
অন্যত্র আছেঃ হেয়াত মামুদ ভূনে আম্বিয়া বাণী।
আমি না রহিব, পুঁথি রহিব নিশানী।
কবি হেয়াত মামুদের উল্লেখিত ৪ (চারটি) কাব্য গ্রন্থ ছাড়াও ফকির বিলাস, নছিহত-ই কামাল, শ্লোকমালা ও কিয়ামত নামা নামে আরো কয়েকটি বইয়ের নাম জানা যায়। তবে এ গুলো বিতর্কিত।
কবির কাব্য গ্রন্থ গুলো পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে লেখা। বাংলা ভাষার পাশাপাশি তিনি অনেক সংস্কৃতি, আরবি, ও ফারসি শব্দ প্রয়োগ করেছেন। তিনি মধ্যযুগীয় কবি ভারত চন্দ্রের সম-সাময়িক কবি ছিলেন। সুদীর্ঘকাল রাজকীয় কর্মকান্ড, অধ্যাত্ব ও সাহিত্য সাধনার পর পীরগঞ্জের এই ক্ষণজন্মা সাধক কবি ১৭৬০-১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সময় পরলোক গমন করেন। তাঁর পবিত্র মাজার শরিফ জন্মস্থান ঝাড় বিশিলা গ্রামে অবস্থিত। উল্লেখিত মাজারটি যুগের পর যুগ ছিল অবহেলিত। গবেষক অধ্যাপক ড. মাযহারুল ইসলাম কর্তৃক গবেষণার পর উক্ত মাজারের প্রতি সরকার দৃষ্টিপাত করেন। বিগত ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে জাতীয় ভাবে কবির মাজারে তাঁর জন্ম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সাবেক পুর্তমন্ত্রি পীরগঞ্জের গর্বিত সন্তান বীর মুক্তি যোদ্ধা জনাব মতিউর রহমানের প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে মাজারের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। মাজার গাত্রে কবির একটি অবিস্মরণীয় বাণী খোদিত আছে। তা হলোঃ
‘‘পড়িব শুনিব লোক,
সম্ভরণ করিব মোক
রহিবে আমার নাম খানি।’’
উনবিংশ শতাব্দীতে পীরগঞ্জের কবিঃ
উনবিংশ শতকে এবং আধুনিক যুগের সুচনা পর্বে পীরগঞ্জের কতিপয় কবি-সাহিত্যিক এর পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে শেখ দোস্ত মোহাম্মদ, কুশাই, সৈয়দ আমানত, শাহ কলিম উদ্দিন, তসমিল উদ্দিন আহম্মেদ, শাহ আঃ রউফ প্রমুখ গণের নাম উল্লেখ্যযোগ্য। বর্তমানের প্রেক্ষাপটে সফি মোতাহার হোসেন, খন্দকার আব্দুল গণি, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, আবুল কালাম আজাদ, মাওঃ শফিকুল্লাহ কবি লুৎফর রহমান সাজু, আঃ মুমিন আকন্দ, অদিয়মান কবি, লেখক ও সাংবাদিক-কলামিষ্ট হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে আসছেন। নিম্নে তাদের সম্যক পরিচয় তুলে ধরা হলোঃ
শেখ দোস্ত মোহাম্মদ
পীরগঞ্জ উপজেলার বাগদুয়ার রসুলপুর গ্রামে উনবিংশ শতাব্দীতে জন্ম গ্রহণ করেন শেখ দোস্ত মোহাম্মদ। তার পিতা মাতার নাম অপ্সাত। জান যায় তিনি একজন সুফি ব্যক্তি
ছিলেন। তার কাব্য নামা অষ্টাদশ শতাব্দীর নামক কবি হেয়াত মামুদ কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে পুথি রচনা করেন। শেখ দোস্ত মোহাম্মদ সেই অনুকরণে উলেলখিত ছন্দনামা পুথি রচনা করেন বলে জানা যায়।
কুশাই
পীরগঞ্জর পারগানার অধীন কেশবপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন কুশাই। তার জন্ম তারিখ পিতা মাতার নাম জানা যায়নি। ১৮১৩ খিস্টাব্দে প্রকাশিত জ্ঞান শব্দ সার নামে রংপুর সাহিত্য পরি তার একখনা পুঁথি দৃষ্ট হয়।
মৌলভী সৈয়দ আমানত আলী
মৌলভী সৈয়দ আমানত আলী জন্ম গস্খহণ করেন পীরগঞ্জের বাউল কতি গ্রামে। তার জন্ম তারিখ পিতা মাতার নাম জানা যায়নি। Iammehul Kosedur নামে তা একখানা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় উনবিংশ শতাব্দীতে।
শাহ কলিম উদ্দিন আহম্মেদ
পীরগঞ্জর অদুরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক সংলগ্ন মকিমপুর গ্রাম। এই গ্রামে ১৮৫৫ সালে জন্ম গস্খহণ করেন শাহ কলিম উদ্দিন। তার পিতা মাতার নাম অজ্ঞাত। তার প্রকাশিত গ্রহন্থ কূল প্রদীব, স্বদৈশী আন্দোলন (১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে) ধুত মেফতা হুচ্ছালাত, মেফতাহুলজান্নাত ইত্যাদি বলে জানা যায়।
তসলিম উদ্দিন আহম্মেদ
পীরগঞ্জর কুমেদপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তসলিম উদ্দিন আহম্মেদ। তার জন্ম তারিখ পিতা মাতার নাম জানা যায়নি। উনবিংশ শতাব্দীতে জননী এবং আমপানামে গ্রন্থ প্রকাশিত দুটি পুঁথির নাম জানা যায়।
মরহুম শাহ্ আব্দুর রউফ
কতিপয় ক্ষণজন্মা মনীষির জন্ম স্থান এই পীরগঞ্জ উপজেলা। তন্মধ্যে শাহ্ আব্দুর রউফ অন্যতম। তিনি ১৮৮৯খ্রিস্টাব্দে পীরগঞ্জের মকিমপুর নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, তার পিতার নাম শাহ কলিম উদ্দিন।
শাহ্ আব্দুর রউফ ভারতবর্ষে মুসলিম জাগরণের প্রথম দিকে তিনি কলিকাতা আলীগড় কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন এবং বি,এল ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবনে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেন রংপুর জর্জ কোটে। এসময় তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করতঃ রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভুমিকা রাখেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম-লীগ থেকে পার্লামেন্টে সদস্য নির্বাচিত হন। রংপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যন হিসেবে তিনি ১৯৩৩---১৯৪০-খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। তার সমাজ সেবা মূলক কর্মকান্ডের স্বীকৃতি স্বরুপ বৃটিশ সরকার তাকে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে খাঁন বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেন।
তিনি কবিতা লিখতেন। তার রচিত ‘‘চতুর্দশী’’ নামে একটি কবিতা গ্রন্থ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়। তার রচিত আর একটি গদ্য গ্রন্থ ‘‘আমার কর্মজীবন’’ (অধুনা বিলুপ্ত)।
শাহ্ আব্দুর রউফ সাহেবের অর্থানুকুল্যে রংপুর সালমা গার্লস হাই স্কুল এবং পীরগঞ্জ কছিমন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীতে তার নামেই পীরগঞ্জ শাহ্ আব্দুর রউফ কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
খন্দকার আব্দুল গণি
পীরগঞ্জ উপজেলার অদুরে বাহাদুরপুর গ্রামে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন খন্দকার আব্দুল গণি। তার পিতার নাম মরহুম খন্দকার নাছির উদ্দিন মাতার নাম --------- তিনি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। রংপুর জেলা স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে চাকুরি থেকে তিনি অবসর যান।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ ছিন্নবীনা, ভাঙ্গা, বাশী, পিযামি, বিষাদ বাশি গীতালী, বিদায় বাশী, স্বর্গপুরী সোনার খনি প্রভূতি।
বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া
বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া পীরগঞ্জের লালদীঘি ফতেপুর গ্রামে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম আব্দুল কাদের মিয়া, মাতার নাম মরহুমা ফয়জান নেছা।
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ৯নং ইউনিয়নের চক করিম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অত:পর পীরগঞ্জ হাইস্কুল। তার পর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে রংপুর জেলা স্কুল থেকে আই এস সি এবং ১৯৬২ খ্রিঃ ঢাকা কলেজ থেকে এম সি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে এটমিক এনার্জির উপর ডিপ্লোমা করেন লন্ডনের ইমপিরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেন পি. এইচ. ডি ডিগ্রি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান যখন আগরতলায় ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ, তখন তার ঘনিষ্ট সহকারি পীরগঞ্জের সাবেক মন্ত্রি মতিউর রহমানের অভিভাকত্বে শেখ হাসিনার সঙ্গে ড. ওয়াজেদ মিয়ার শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এবং কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
এই মহান বিজ্ঞানী ২০০৯ খ্রিঃ ৯ মে তারিখে পরলোক গমন করেন। ফতেপুর গ্রামে তার পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
মতিউর রহমান
পীরগঞ্জের বীর সন্তান সাবেক মন্ত্রি মতিউর রহমান ১৯ খ্রিস্টাব্দে রছুলপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ------- এবং মাতার নাম --------- খ্রিস্টাব্দে বি.এ. পাশ করার পর মতিউর রহমান ঢাকায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। আপন মেধা, সততার কারণে অত্যাল্প সময়ের মধ্যে তিনি দেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সেই সঙ্গে শেখ মুজিবর রহমানের একজন ঘনিষ্ট সহকারী হিসেবে মতিউর রহমান ছয়দফা দাবি নিয়ে উত্তর বঙ্গে প্রচারনা শুরু করেন। এসময় সরকারের বহু মামলা ও নির্যাতন চলতে থাকে। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ হলে তার অনুরোধে উকিল বাবা হিসেবে মতিউর রহমান শেখ হাসিনা ও ড. ওয়াজেদ মিয়ার শুভ বিবাহ নিস্পন্ন করেন। বেক খালাশ পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলন অত্যান্ত বেকবান করেন। অসহযোগ
গণঅভুত্থান শুরু হয়। বাধ্য হয়ে সাধারণ নির্বাচন দেন পাকিস্তান সরকার। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন মতিউর রহমান পীরগঞ্জের মানুষ বিপুল ভোটে তাকে এম.এ.এ নির্বাচিত করেন --------- পাকিস্তান সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ক্ষেপন ও প্রহবান করতে থাকলে ১৯৭১ খ্রিঃ ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যান। এহিয়া খান এদিকে দেশময় শুরু হয় গণ হত্যা গৃহ দাহ নারী নির্যাতন। দেশের মানুষ দলে দলে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। বলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন। ১৯৭১ খ্রিঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় মতিউর রহমান ছয় নং সেক্টরের অধীনে নয় জনের চেয়ারম্যান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব পালন করেন।
দেশ হানাদার মুক্তি হলে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রি হিসেবে পীরগঞ্জ সাধক কবি হেয়াত মামুদের পবিত্র মাজার শরিফ নির্মানের কাজ শুরু হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ এম,পি
পীরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আবুল কালাম আজাদ (এমপি)। তিনি ------- খ্রিঃ -------গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম ডাঃ তসির উদ্দিন মাতার নাম মরহুমা ---------। বল্যকাল থেকে তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশ ও দশের সেবায় আত্ম নিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। দেশ হানাদার মুক্ত হলে ঢাকায় গিয়ে তিনি গার্মেন্টস ব্যবসায়ে মনযোগ দেন। অত্যাল্প সময়ের মধ্যে সততা ও মেধার দ্বারা তিনি ঢাকা জিরানি বাজারে সাথী গার্মেন্টস সহ আরো কয়েকটি ব্যবসার সাথে জড়িহন। বর্তমানে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি।
ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতে বিশেষ অবদান রাখেন আবুল কালাম আজাদ। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে পীরগঞ্জের উপনির্বচনে অংশ গ্রহণ করায় পীরগঞ্জবাসী তাকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেন। বর্তমানে তিনি রংপুর-২৪, পীরগঞ্জ-০৬ আসনের মাননীয় জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি লেখালেখির সঙ্গেও জড়িত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের নাম -----------।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শফিকুল্লাহ এর জীবন ও সাহিত্য কর্ম
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শফিকুল্লাহ একজন দেশ বরেণ্য ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষক তিনি সুদীর্ঘ ১২ বৎসর বিভিন্ন মাদ্রাসা এবং ৩৫ বৎসর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি নোয়াখালী জেলার আবু তোরাব নগর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলাধীন চতরা গ্রামে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে থাকেন। তার পিতার নাম আল হাজ্ব মোবারক উল্লাহ এবং মাতার নাম শাফিয়া খাতুন। তিনি প্রথমত গ্রামের মক্তবে কোরান মাজিদ শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে চাটখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে আলিম,১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ফাজিল, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে কামিল (হাদিস) পাশ করেন। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে কামিল (তাফসির), ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কামিল (ফিকহ) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম এম,ইএস কলেজ থেকে নাইট সিপটে বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসাবে অংশ গ্রহণ করে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে এইচ এস সি এবং ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বি এ পাশ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে আরবি বিষয়ে এম, এ এবং ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে পি, এইচ, ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি একজন সুলেখক ছিলেন তার প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহের মধ্যে ইমাম তাহাভীর জীবন ও কর্ম, উলুমুল কোরআন, হাদিসের আলোকে জিনজাতী ও ইবলিস, সহি বুখারির ব্যাখ্যা আওনুল বারী ইমাম মুহাম্মদ আল বুখারী (রহঃ) ও তার জামি অন্যতম। এছাড়াও তার অপ্রকাশিত অনেক গ্রন্থ রয়েছে। তার প্রবন্ধ সমূহ: বিভিন্ন ইসলামি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। জানা যায় তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬টি, অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি ১২টি, প্রবন্ধের সংখ্যা ১৫০টি। তিনি জাতীয় পাঠ্যক্রম পুস্তক ইসলামী শিক্ষা গ্রহন্থের একজন রচয়িতা ছিলেন। যা ৬ষ্ট শ্রেণি হতে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয়ে থাকে। তিনি একজন গবেষণা তত্বাবধায়কও ছিলেন। তার তত্বাবধানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ২৫ জন শিক্ষক ও গষেক পি এইচ ডি এবং ৫ জন এম, ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. মুহাম্মদ শফিকুল্লাহ দীর্ঘ কর্ম জীবনের সমাপ্তি টানিয়ে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শাহদাৎ বরণ করেন। তাকে তার পারিবারিক কবরস্থান চতরায় সমাহিত করা হয়।
প্রয়াত কমরেড বাবু মণিকৃষ্ণ সেন
বাবু মণিকৃষ্ণ সেন ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ১ নভেম্বর রাজবাড়ী জেলার বারাদি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বেনী মাধব সেন। মাতার নাম প্রমোদা সুন্দরী। তারা পাঁচ ভাই বোন। তার মধ্যে মণিকৃষ্ণ সেন তৃতীয় । তার পিতা পীরগঞ্জ উপজেলার
কাবিলপুরে জমিদারী সেরেস্তায় কাজ করতেন। মাত্র ছয় বৎসর বয়সে মণি কৃষ্ণ সেন কাবিলপুরে চলে আসেন। তিনি কাবিলপুর মাইনর স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ করেন। তারপর আবার নিজ বাড়িতে চলে যান। সেখানে তার বোনের কাছ থেকে পড়াশুনা করেন রাজবাড়ী হাইস্কুলে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণি পাশ করেন। এর মধ্যে তার পিতৃ বিয়োগ ঘটে। তখন সে ফিরে আসেন রংপুরে। রংপুরে কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে মেট্টিক পাশ করেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে বি,এ পাশ করেন রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে। অতঃপর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম, এ এবং এল, এলবি ডিগ্রি লাভ করেন। কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা কালীনই তিনি জমিদার ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। সদস্য হন যুগান্তর দলের। সে সময় জমিদার ও বৃটিশ কর্তৃক প্রজা পীড়নে তার মনকে ব্যথিত করে তোলে। তাই তিনি হয়ে ওঠেন সংগ্রামী মনোভাবাপন্ন। ফলে বৃটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে যান তিনি। বিপ্লবী কর্মকান্ড করতে গিয়ে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে পুটিয়ার ট্রেন ডাকাতী মামলায় গ্রেফতার করে তাকে রাজশাহী জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। এ সময় তিনি মার্কসবাদী রাজনীতিতে পুরাপুরি ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে যোগ দান করেন কমিউনিষ্ট পার্টিতে।
বাবু মণিকৃষ্ণ সেন তেভাগা কৃষক আন্দোলন, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন এবং মওলানা ভাষানীর সাথে ফুলছড়িতে বিশাল কৃষক সম্মেলনে সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্ত ফ্রন্ট গঠিত হলে কাজী আঃ হালিম, মতিউর রহমান, সুফি মোতাহার হোসেন, সহ বাবু মণিকৃষ্ণ সেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে আইয়ুব খাঁনের মার্শাল ল, তে আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাদন্ড ভোগ করেন মণিকৃষ্ণ সেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথমার্ধে তিনি পীরগঞ্জের সখিপুর গ্রামে আত্মগোপনে থেকে মুক্তি যুদ্ধের সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি চলে যান ভারতে। ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতা কর্মীদের সাথে যোগসুত্র রচনা করেন। জরুরী ভিত্তিতে ইলা মিত্রের বাসায় স্থাপন করেন মুক্তি যুদ্ধের ক্যাম্প। মতিউর রহমান, শংকর বসু, ফয়েজ আহম্মদ প্রমুখগণের সহযোগিতায় তিনি গড়ে তোলেন `NORTH BENGAL REVOLUTION CAUNCEL১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে দেশ হানাদার মুক্ত হলে মুক্তি যোদ্ধাদের বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি প্রবেশ করেন রংপুর শহরে।
রাজনীতি জেল জুলুম, কারাভোগের মধ্য দিয়েও তিনি ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে পীরগঞ্জ মিঠাপুকুরে বসন্ত রোগের মহামারীতে সেবা কার্য পরিচালনা করেন। স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভুখা-ফাঁকাদের জন্য খুলে দেন লংগর খানা। পরিশেষে
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে পীরগঞ্জের কাবিলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘‘প্রমোদা সুন্দরী সেন কল্যাণ ট্রাস্ট’’ । সে ট্রাস্টে দান করে যান তার সমুদয় বিষয় সম্পত্তি। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে রংপুর পৌর সভায় তাকে গুণীজন সংবর্ধনায় ভূষিত করা হয়। ১৯৯০ খিস্টাব্দের ১৬ ই ডিসেম্বরে পীরগঞ্জ বিজয় দিবস অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বাবু মণিকৃষ্ণ সেন। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। অসুস্থ্য অবস্থায় ভারতের পাটনায় তার ভাইপোর বাসায় তিনি ২৮ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাষ ত্যাগ করেন। বাবু মণিকৃষ্ণ সেন পীরগঞ্জের একজন অবিসংবাদিত নেতা। তিনি জীবনে দার গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন চিরকুমার।
পীরগঞ্জের মজলুম জননেতা
কাজি আব্দুল হালিম
পীরগঞ্জের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা কাজি আব্দুল হালিম। তিনি ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে পীরগঞ্জের পঁচা কান্দর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজি হায়দার আলী। মাতার নাম কুলসুমা খাতুন। তিনি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে রায়পুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্টিক পাশ করেন। অতঃপর গাইবান্ধা কলেজে আই,এ ক্লাসে ভর্তি হন। ছাত্র কাল থেকেই তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি কন্ঠস্বর। সেহেতু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অন্যায় শোষনের বিপক্ষে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় যুবগলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে চিহ্নিত হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে গাইবান্ধা কলেজে তিনি ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং পীরগঞ্জের সাথে রাজনৈতিক যোগ সুত্র রক্ষা করেন। এ সময় তাকে গ্রেপ্তার করে রংপুর জেল হাজতে প্রেরণ করেন পাকিস্তান সরকার। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে আবার তিনি গ্রেপ্তার হন। সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তাকে বার বার হতে হয় নানা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার । পুলিশী হয়রানি, জেল জুলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়ে পীরগঞ্জের এই মজলুম জননেতা ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে যুক্ত ফ্রন্টের পক্ষে বিভিন্ন এলাকায় জন সভায় জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে বেড়ান। এ সময় সরকারের কঠিন রোষানলে পড়ে তিনি আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। তাকে গ্রেপ্তার করতে না পেরে তার বাড়িস্থ মালামাল নিলামে বিক্রয় করে সরকার। এমতাবস্থায় তার প্রার্থী আবু হোসেন সরকার বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হন। কুচক্রী মহলের চক্রান্তে অত্যল্প সময়ের মধ্যে ভেঙ্গে যায় যুক্ত ফ্রন্ট সরকার। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে বামপন্থি রাজনীতিতে জড়িত থেকে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার বিরুদ্ধে অশোভনীয় উক্তি
করার অভিযোগে আবার তিনি গ্রেপ্তার হন এবং এক বৎসর কারাদন্ড ভোগ করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে ন্যাপ পার্টি গঠিত হলে তিনি মওলানা ভাষানী ন্যাপে যোগদান করেন। ন্যাপ পার্টিতে তিনি ছিলেন রংপুর জেলা সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। পাকিস্তান সরকারের পতন আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলনে পীরগঞ্জের পুরোধা ছিলেন কাজি আব্দুল হালিম।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তার বাস ভবনে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। স্বার্থান্বেষী মহল। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে সরকার আবারও তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভাষানী ন্যাপ থেকে কুড়ে ঘর মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেন তিনি। কিন্তু এলাকার মানুষ সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শে উজ্জীবিত না হওয়ায় নির্বাচনে পরাজিত হন কাজি আব্দুল হালিম। সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ১৯৮৯ খিস্টাব্দে সোভিয়েত রাশিয়া সফর করেন।
কাজি আব্দুল হালিম ছিলেন একজন জন দরদী, দেশ হিতৈশী এবং শিক্ষানুরাগী সাদা মনের মানুষ। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় পীরগঞ্জের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পীরগঞ্জ কছিমন নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, শাহ আব্দুর রউফ কলেজ, বালুয়া গালর্স হাইস্কুল, পীরগঞ্জ মাদ্রাসা এবং হাজী বয়েন উদ্দীন পাবলিক স্কুল প্রভৃতি তার শিক্ষানুরাগী মনের নিদর্শন। পীরগঞ্জের আজীবন কর্মক্লান্ত সংগ্রামী মজলুম জননেতা কাজি আব্দুল হালিম বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন তারিখে নিজ বাসভবনে পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে পড়েন সমগ্র পীরগঞ্জবাসী।
পীর হযরত আব্দুল কাদের (রহঃ)
বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারের ভূমিকায় সুফি সাধকগণের ভূমিকাই প্রধান। বিশেষকরে সুলতানী আমল থেকে মোঘল আমল পর্যন্ত আরব-পারস্য থেকে আগত অসংখ্য সুফি-সাধকগণ এদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেন। সমগ্র উত্তর বঙ্গে ইসলাম প্রচারক হিসেবে হযরত শাহ ইসমাঈল গাজি (রহঃ) এর নাম উল্লেখযোগ্য। পীরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছিল তার আস্তানা। সে সুবাদে সমগ্র পীরগঞ্জ উপজেলাই হয় পির-প্রভাধীন এলাকা। সেকাল থেকেই পীরগঞ্জে জন্ম নেয় অনেক সুফি-সাধক। গড়ে ওঠে তাদের আস্তানা-খানকা শরিফ। সুফিগণের চারনভূমি, সুফিবাদের লালন ভুমি এই পীরগঞ্জ। বর্তমানেও পির, দরবেশ নামে অনেক সুফি রয়েছে পীরগঞ্জে। তাদের সকলের স্বীকৃত ও শ্রদ্ধেয় পির কেবলার জন্মস্থান ৪নং ইউনিয়নের বউলবাড়ি গ্রামে। তার নাম হযরত আব্দুল কাদের (রহঃ) বসবাস করতে
থাকেন দিনাজপুর জেলার অর্ন্তগত ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া গ্রামে। মাঝে মাঝে জন্মস্থান পীরগঞ্জের বউলবাড়িতে অবস্থান করেন তিনি। উভয়স্থান থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের হাজার হাজার গোমরাহি মানুষকে আল্লার পথে দিক নির্দেশনা দেন পির সাহেব কেবলা। সেই সাথে মানুষের দুনিয়াবি রোগ-শোক, বালা-মছিবত, মামলা-মোকদ্দমা প্রভৃতি সমস্যার জন্য দোয়া করেন আল্লার দরবারে। তার সান্নিধ্য লাভে হাজার হাজার গোমরাহি মানুষ আল্লাহ-রাসূল (সঃ) পাকের সঠিক পথের সন্ধান লাভ করেন। আত্মিক-সাধনায় উৎকর্ষ লাভ করেন অনেকেই। পীরগঞ্জ উপজেলায় সুফি-সাধক মহলে আজও তার নাম নির্দ্ধিধায় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকেন সকলেই। এই ক্ষণজন্মা মনীষি ....................................খ্রিস্টাব্দের ........................................... তারিখে সিংড়া গ্রামে শাহাদত বরণ করেন। সেখানে তাঁর মাজার শরিফ বিদ্যমান রয়েছে।
আব্দুল জলিল প্রধান
মানুষ মরণশীল। কোন কোন মানুষের মরণে মানুষ হাসে, আনন্দ পায়। আর কোন কোন মানুষের মরণে মানুষ কাঁদে আঘাত পায়। সৃষ্টি করে বেদনা বিদুর পরিবেশ। মরণোত্তর তার স্মৃতি গুলো কথা বলে। আর তাকে নিয়ে রচিত হয় ইতিহাস, গান, গল্প, কবিতা । এমন এক কিংবদন্তির নায়ক মরহুম আব্দুল জলিল প্রধান। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ছাত্র নেতা, দক্ষ চেয়ারম্যান, জাতীয় সংসদ সদস্য এবং রাজনীতিজ্ঞ।
আব্দুল জলিল প্রধান ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে রংপুর জেলার, পীরগঞ্জ থানাধীন চতরা ইউনিয়নের কুয়াতপুর হামিদপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ইউসুফ উদ্দীন প্রধান। মাতার নাম বিবি জান নেছা। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ছাত্র রাজনীতিতে অংশ গ্রহন করেন।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সর্ব প্রথম ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২-৭৩ ইং খ্রিস্টাব্দে। যুবক আব্দুল জলিল প্রধানের ন্যায়-নিষ্ঠা, নিঃস্বার্থ ও নির্ভীক কর্ম তৎপরতায় ইতিমধ্যে সমগ্র চতরা ইউনিয়নে তিনি সাধারণ জনগণের আস্তা অর্জন করতে সক্ষম হন। আর সে কারণেই গ্রাম থেকে সকল শ্রেণির মানুষ তার কাছে এসে চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রস্তাব দিতে থাকে। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরবর্তীতে জনগণের চাপে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন এবং বিপুল ভোটে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।
চতরা ইউনিয়ন ছিল সেকালে একটা বন্যা কবলিত ইউনিয়ন। সমান্য বৃষ্টির জলে ডুবে থাকত করতোয়া নদী বিধৌত ১৫টি গ্রাম। চতরা হাটের পশ্চিম পার্শ্বস্থ উল্লেখিত ১৫টি গ্রাম যেমনঃ গৌরিশ্বেরপুর , কাঁটাদুয়ার, বড় বদনা পাড়া, চকভেকা, চন্ডিদুয়ার, বাটিকামারী, নিশ্চিন্তবাটি, সন্দলপুর, সুরানন্দপুর, জলামহল, কুমারপুর, সোনাতলা, কুয়াতপুর হামিদপুর, ঘাষিপুর, অনন্তপুর গ্রাম গুলোতে প্রায় বৎসরই বন্যায় ফসলের ক্ষতি হত। চতরা হাটের সাথে যোগাযোগের ভাল রাস্তা ছিল না। বর্ষা মŠসুমে নৌকা বা নদী সাঁতরে পারাপারের ব্যবস্থা হত।
উক্ত গ্রাম গুলোর সাথে সংযোগ রাস্তায় মাঝে মধ্যে ছিল ভাঙ্গা। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও বা বুক পর্যন্ত পানি আর পানি। আর চতরা হাটের উত্তর দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের গ্রাম ও খাস জমি গুলো ছিল লালমাটি, ইট পাথরের টুকরায় ভরা। চৈত্রমাসে ওকড়া ফলত না জমি গুলোতে। খালি পাঁয়ে তো দুরের কথা, টায়ারের জুতা পাঁয়ে দিয়েও হাটতে মনে হত পাঁয়ের তালা ভেদ করে আসছে কঙ্করময় লালমাটি।
ইউনিয়নের প্রায় মানুষই বাস করত দরিদ্র সীমার নীচে। অনাহারে অর্দ্ধাহারে জীবন কাটাত তারা । মাথা গোঁজার ঠাই ছিলনা অনেকের। স্বাস্থ্য, শিক্ষার ছিল না কোন উন্নত ব্যবস্থা।
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরেই আব্দুল জলিল প্রধান প্রথমেই নজর দেন ইউনিয়নের এই সকল অনুন্নত রাস্তা-ঘাটের প্রতি। প্রথম ৫ বৎসরের মধ্যেই তিনি বরাদ্দ ছাড়াও নিজ অর্থ ব্যয়ে ইউনিয়নের সকল রাস্তা সংস্কার করে যানবাহন ও জনগণের চলাচল উপযোগী করেন। প্রয়োজনীয় স্থানে রিং কালভার্ট এর ব্যবস্থা করেন। চতরা হাটের মচ্চ নদীর উপরে শিশু ক্লিনিকের সন্নিকটে নতুন রাস্তা নির্মাণ করে প্রথমে বাঁশের সাঁকো ও পরবর্তীতে মিনি ব্রীজের ব্যবস্থা করেন তিনি।
বৃক্ষ রোপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে আব্দুল জলিল প্রধান ইউনিয়নের প্রত্যেকটি রাস্তার দু’ পার্শ্বে অন্যান্য বৃক্ষের পাশাপাশি ৮২০০০/- (বিরাশি হাজার) নারিকেল চারা রোপন করেন। সঠিক পরিচর্যার অভাবে বেশ কিছু গাছ বিন্ষ্ট হলেও হাজার হাজার নারিকেল গাছ বিগত কয়েক বৎসর যাবৎ বিপুল পরিমান ফল দান করছে। এগুলি ইউনিয়নের সম্পদ। নারিকেল গুলির বিক্রয় লব্ধ অর্থ ইউনিয়নের উন্নয়ন তহবিলে আর্থিক প্রবাহের সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশে কোন ইউনিয়নে এত বিপুল সংখ্যক নারিকেল গাছ আছে কিনা তা আমার জানা নাই। দেশের বড় বড় কর্মকর্তা, এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল প্রধানের এমন জন বিরল কর্মকান্ডে মুগ্ধ হয়ে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারিতে এ ইউনিয়নটি পরিদর্শন পূর্বক তাকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনে উৎসাহিত করেন।
ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণে বড় বদনাপাড়ার টোংরার দহ, চকভেকা, কাঁটাদুয়ার, বাটিকামারী, সন্দলপুর, সোনাতলা, কুয়াতপুর হামিদপুর (মাটিয়াল পাড়ার) মধ্য দিয়ে মেছনার গড় পর্যন্ত অদ্যাবধি যে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধটি দৃষ্টি গোচর হয় তা এম, পি , আব্দুল জলিল প্রধান কর্তৃক নির্মিত। চকভেকা করতোয়া নদীর সাথে সংশ্লিষ্ট সুইচ গেটটি তারই পরিকল্পিত।
ইউনিয়নের গরীব দুঃখী মানুষের কন্যা দায়, মৃত্যুর কাফন-দাফন ও জটিল-কঠিন রোগীর চিকিৎসার ব্যয় ভার বহন তার বদান্যতার উল্লেখযোগ্য প্রমান।
তিনি ২৯ ডিসেম্বর ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে দিবাগত রাতে ইন্তেকাল করেন। চলে যান পরম বন্ধুর সান্নিধ্যে।
রবীন্দ্র মানসে পীরগঞ্জের স্মৃতি
পীরগঞ্জ অতি প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে এক স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্থান। আপামর বাঙালীর হাস্য রসের কল্প কথার নায়ক হবু চন্দ্র রাজা আর গবু চন্দ্র মন্ত্রির বিচরণ ক্ষেত্র এই পীরগঞ্জ। যাদের মন্ত্রে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও।
প্রাচীন ‘‘নাথ’’ সাহিত্যে গোপিনাথ সন্যাসের পরিচয় সর্বজন বিদিত। এই গোপিনাথ সন্যাসই গোবিন্দ চন্দ্র রাজা। যার রাজধানী ছিল বৃহত্তর রংপুর জেলার ডিমলা থানার পাটিকা নগরে। উল্লেখিত রাজার পূত্র ভবচন্দ্রের রাজ প্রাসাদ ছিল পীরগঞ্জের তৎকালীন বাগদুয়ার পরগণার উদয়পুরে (বর্তমানে মিঠাপুকুর উপজেলার অন্তর্গত)। সেখানে এখনো তাঁর রাজ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে। ভব চন্দ্র রাজা বাগ দেবির উপাসক ছিলেন। উল্লেখিত স্থানে বাগ দেবির মন্দির দৃষ্ট হয়। উল্লেখিত রাজার এক নিকট আত্মীয়র নাম নোরা রাজা। পীরগঞ্জে নোরার পাট ও নোরার গড় তার স্মৃতি বহ। এই ভব চন্দ্র রাজার পুত্র হবু চন্দ্র।
হবু চন্দ্র রাজা আর গবু চন্দ্র মন্ত্রির নামে বাংলাদেশে অনেক রসাত্বক কাহিনী প্রচলিত আছে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ব্যাঙ্গ কবিতা ‘‘হিং টিং ছট’’ কবিতা শুরু করেছেন এভাবেঃ
‘‘স্বপ্ন দেখেছেন রাতে হবু চন্দ্র ভূপ,
অর্থ তার ভাবি ভাবি গবু চন্দ্র চুপ।’’
.........................................
‘‘হবু চন্দ্র রাজা বলে গবু চন্দ্রে ডেকে
কাঁদতে কেহ পারবে নাক রাজ্যে আজ থেকে’’
ইত্যাদি ইত্যাদি।
যেহেতু পীরগঞ্জের মাটিতে উল্লেখিত রাজা ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের গুচ্ছ মুল নিহিত ছিল, সেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সু বিশাল সমুদ্র বক্ষে তার সফেদ ঢেউ হিন্দোলিত হয়েছিল এক কালে। আর তাই তো রবীন্দ্র মানসে পীরগঞ্জের স্মৃতি সিন্ধুতে বিন্দু দানেরই নামান্তর । পীরগঞ্জের এ আরেক ইতিহাস, আরেক ঐতিহ্য।
পীরগঞ্জের বাঁশ শিল্পঃ
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় পীরগঞ্জেও বাঁশ শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। ঘরবাড়ির খুঁটি, বেড়া ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার ছাড়াও বাঁশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চিরসঙ্গী। আগের যুগে গ্রামে নবজাতকের নাড়ি ছেদন করা হত বাঁশের চেঁচ দিয়ে। আর আবহমান কাল থেকে এ পর্যন্ত গ্রামীন মানুষের শেষ কৃতকার্য পর্যন্ত বাঁশের ব্যবহার সার্বজনীন। তাছাড়া এই বাঁশ দিয়ে গৃহস্থালি কাজের নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ধামা, কুলা, খই চালা, খাঁচা, টুক্রি, ডাড়্কি, খলুই, চাঁটাই, ঘরের ছাদসহ শত শত ধরনের উপকরণ তৈরি হচ্ছে। আর বাঁশ শিল্পকে ব্যবহার করে এ এলাকার হাজার হাজার দরিদ্র মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। বাঁশ শিল্পীদের মধ্যে পীরগঞ্জের চতরা এলাকার মাহালিরা শ্রেষ্ঠ। মাহালি ছাড়াও চতরা খালাশপীরসহ বিভিন্ন হাটে মুসলমান শিল্পীদেরও এ সমস্ত শিল্পকর্ম দৃষ্ট হয়।
পীরগঞ্জের পাল বংশ ও মৃৎ শিল্পঃ
পীরগঞ্জ থানা/ উপজেলা সদর থেকে ০৮ কিঃ মিঃ উত্তর-পশ্চিমে চন্ডিপুর গ্রাম। এখানে পাল বংশীয় লোকজন বসবাস করে। তাদের মৃৎ শিল্প চমক প্রদ। মাটির হাঁড়ি-পাতিল, বাটনা, চাড়ি, মটকা সহ পুতুল প্রভৃতি খেলনা তৈরি করতঃ হাট বাজার ও মেলায় বিক্রয় করে। এটাই তাদের জীবিকা অর্জনের প্রধান পেশা। চন্ডিপুর ছাড়াও কুমেদপুর এবং বড় দরগা শান্তিপুরে তাদের বসতি আছে।
প্রসংগতঃ পাল বংশের ইতিবৃত্ত আলোচনা করতে গেলে প্রাচীন ভৌগোলিক বিভাগ নিয়ে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। জানা যায়, আজকের বাংলাদেশ প্রাচীন যুগে ৪ ভাগে বিভক্ত ছিল। (১) পুন্ড্র বা পুন্ড্র বর্ধণ (২) বঙ্গ (৩) সমতট (৪) হরিকেল
১। পুন্ড্র বা পুন্ড্র বর্ধণঃপৌরাণিক সূত্রে জানা যায় যে, বলি রাজার স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে দীর্ঘত্তমা ঋষির ঔরষে ৫ জন সন্তান জন্ম নেয়। বয়ঃ প্রাপ্ত হলে রাজা তাদেরকে রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। উল্লেখিত ৫ ভাই তাদের রাজ্য থেকে পূর্ব দিকে আগমন করতঃ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুক্ষ (রাঢ়) নামে ৫ টি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ মোতাবেক জানা যায়, বগুড়া, দিনাজপুর এবং রাজশাহী পুন্ড্র বর্ধণের অন্তর্গত ছিল। নীহার রঞ্জন রায়ের মতে ‘‘মোটা মোটি সমস্ত উত্তর বঙ্গই বোধ হয় ছিল পুন্ড্র বর্ধণের অধিন’’। পরবর্তীতে পাল ও সেন বংশের আমলে পুন্ড্র বর্ধণের সীমা আরো বিস্তৃত হয়।
২। বঙ্গঃপ্রাচীন যুগের ঐতিহাসিক তথ্য মোতাবেক বঙ্গের অবস্থান ও সীমা সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। নীহার রঞ্জন রায়ের মতে, ‘‘বঙ্গের উত্তরাঞ্চলে উত্তর সীমা ছিল পদ্মা এবং সমূদ্রশায়ী খাল-নালা সমাকীর্ণ দক্ষিনাঞ্চল ছিল অনুত্তর বঙ্গ’’।
৩।সমতটঃসমূদ্র গুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভ লিপি মোতাবেক সমতট রাজ্যের পূর্ব সীমান্তবর্তী করদ রাজ্য গুলোর মধ্যে নেপাল, ডবাক, কর্তৃকপুর, কামরূপ ও সমতটের নাম জানা যায়। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ সমতটকে সমূদ্রের তীরস্থ নীচু ও জলাভূমিপূর্ণ দেশ বলেছেন এবং তা কামরূপের (আসাম) দক্ষিণে অবস্থিত বলে মন্তব্য করেছেন।
৪। হরিকেলঃপ্রাচীন গ্রন্থাবলীতে হরিকেলকে হরিকলি ও হরিকোলা বলা হয়েছে। এর অবস্থান সম্পর্কে কেউ কেউ বঙ্গ ও হরিকেলকে একই জনপদ বলেছেন। কেউ কেউ বঙ্গ, সমতট ও হরিকেলকে ৩ টি পৃথক পৃথক জনপদ বলে মন্তব্য করেছেন। কোন কোন গ্রন্থে শ্রীহট্ট এবং হরিকেলকে এক জনপদ বলে উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে বি,এন মুখার্জীর মন্তব্যটি উল্লেখযোগ্য ‘‘Hence the Legend Harikela on them Suggests the Existence of a kingdom called harikela in the territory of the Chittagong District during C. seventh centuary AD.”
ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পাল ও সেন বংশঃ
বাংলায় মৌর্য শাসন:-মহাভারতের বর্ণনা মতে, বলি রাজার স্ত্রী সুদেষ্ণা গর্ভে জনৈক দীর্ঘত্তমা ঋষির ঔরষে পাঁচ জন পুত্র জন্ম নেয়। তারা অঙ্গ,বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুক্ষ্ম নামে পাঁচটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সম্রাট আলেক জান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে ভারতের উত্তর- পশ্চিম অংশ আক্রমণ করেন। আলেক জান্ডারের প্রত্যাবর্তনের পরে ভারত বর্ষে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, মৌর্য বংশীয় রাজা চন্দ্র গুপ্ত মৌর্য। বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চল মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীন ছিল বলে মহাস্থানের শিলালিপিতে প্রমাণ পাওয়া যায়।
গুপ্ত শাসন:- গুপ্ত যুগে সমগ্র উত্তর বঙ্গে গুপ্ত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানা যায়। সে সময় এ অঞ্চলেন প্রাদেশিক শাসনের কেন্দ্র ছিল পুন্ড্র নগর।
গুপ্তোত্তর যুগ:- ৬ষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে গুপ্ত সম্রাজ্যের পতন হয়। উত্তর ভারতে রাজত্ব করেন খন্ড খন্ড রাজ বংশ। তাদের মধ্যে গোপ চন্দ্র ছিলেন বিশেষ ক্ষমতাধর। পরবর্তীতে ৫২৫ --- ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উল্লিখিত রাজারা রাজত্ব করেন। ইতিহাসে তারাই পরবর্তী গুপ্ত রাজা বলে পরিচিত। ৬ শতকের শেষ দিকে তাদের শাসন ব্যাবস্থা বিলুপ্ত হয়।
সামন্তরাজ শশাঙ্ক:- পরবর্তী গুপ্ত বংশের পর বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে সামন্তরাজ শশাঙ্ক বিশাল স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ৬০০---৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
শশাঙ্কের পরে গৌড় রাজ্যে রাজত্ব করেন সম্রাট হর্ষবর্ধন এবং কামরূপ রাজ ভাস্কর বর্মা। ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পরে গৌড় রাজ্য বহিঃ শত্রুর দ্বারা পূনঃ পূনঃ আক্রমিত হয় এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একশত বৎসর পর্যন্ত চলতে থাকে অন্যায়-অত্যাচার, যুলুম-নির্যাতন। এই যুগকে বলা হয় ‘‘মাৎসান্যায়’’ যুগ।
সমতটের ইতিবৃত্ত:- এই মাৎসান্যায় অরাজকতা গৌড় বা বাংলার উত্তরাঞ্চল ও তার পাশা-পাশি এলাকায় চলতে থাকে। তবে সমতট বা বাংলার পূর্ব-দক্ষিন অঞ্চল ছিল উহার প্রভাব মুক্ত। কারণ এ অঞ্চলে তখন ভদ্র বংশ, খড়গ বংশ, রাত বংশ, লোকনাথের বংশ ও দেব বংশ রাজত্ব করেন। তারা রাজত্ব করেন ৯ শতকের কিছু কাল পর্যন্ত। তারপর ৯০০---১০৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চন্দ্র রাজ বংশীয় রাজারা রাজত্ব করেন। তাদের মধ্যে ত্রৈলোক্য চন্দ্র, শ্রীচন্দ্র, কল্যাণ চন্দ্র, লড়হ চন্দ্র ও গোবিন্দ চন্দ্রই প্রধান।
রাজা গোবিন্দ চন্দ্র ১০০৫--- ১০৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। গোবিন্দ চন্দ্রের পরে এই অঞ্চল চলে যায় বর্মন ও সেনদের হাতে।
পাল বংশ:- খ্রিস্টিয় ৮ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন পাল বংশীয় রাজা গোপাল। তিনি বাংলার মাৎসান্যায় যুগের অবসান ঘটান। প্রায় ৪০০ বৎসর পর্যন্ত এই বংশ বাংলায় রাজত্ব করেন। পাল বংশীয় কয়েক জন বিখ্যাত রাজা ধর্মপাল, দেবপাল, মহিপাল ও রামপাল। উল্লেখ যে, পাল বংশীয় রাজা ধর্মপাল পাহাড়পুরে বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেন।
পীরগঞ্জের পালোগড় (দানেশ নগর) এলাকায় এই বংশের রাজাদের পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। ১নং চৈত্রকোল ইউনিয়নের এই সমস্ত এলাকা প্রত্নতত্ত্ব গবেষনার দাবী রাখে। যাহোক পাল বংশের শেষ রাজা মদন পালের সময় (১১৪০---১১৫৫খ্রিঃ) এই রাজ বংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন সেন বংশ বাংলার সিংহাসনে আরোহন করেন।
বর্মন ও সেন বংশ:- সমতট অঞ্চলে পাল রাজত্বের অবসানের পর বর্মন রাজ বংশ এবং পরে সেন রাজ বংশের সুচনা হয়। ভারতের কর্ণাটক ও রাঢ় অঞ্চল থেকে সেনরা বাংলাদেশে আসেন। এ বংশের প্রথম রাজা বিজয় সেন। তার পিতা হেমন্ত সেন এবং পিতামহ সামন্ত সেন। বিজয় সেন এর পুত্র মহারাজা বল্লাল সেনের রাজত্ব করেন ১১৫৮--- ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। বল্লাল সেন এর পুত্র মহারাজা লক্ষন সেন ১১৭৯ ---- ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। উল্লেখ্য যে উল্লেখিত সেন রাজাদের অন্যতম রাজা নীলাম্বর সেন কামরূপ-কামতা রাজ্যে রাজত্ব করতেন। পীরগঞ্জের চতরা এলাকায় নীল দরিয়া নামক স্থানে তার দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়।
বাংলায় মুসলিম শাসনঃ ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে লখনৌতি (গৌড়) আক্রমণ করতঃ মুসলিম শাসনের সুত্রপাত ঘটান। তৎপরে বাংলায় সুলাতানী, পাঠান ও মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীতে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর শাসন ব্যবস্থা চলে যায় কোম্পানির হাতে। ২০০ বৎসর পরাধীনতার পরে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করি।
এখানে উল্লেখ্য যে, সুলতানী আমলেই হযরত শাহ ইসমাঈল গাজি (রহঃ) ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য বাংলায় আগমন করেন। সর্বশেষ অভিযানে তিনি পীরগঞ্জের নীল দরিয়ার দূর্গ দখল করতঃ বড় বিলায় প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন করেন। একথা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।